অনুপম রায়, বেলাকোবা, ১৮ মে ২০২২: এই চমচমের সফর শুরু উনবিংশ শতকে ময়মনসিংহ জেলায়। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি এলাকায় সে প্রথম পায় তার রূপ। ক্রমেই দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ল খ্যাতি। ‘চমচমের রাজধানী’ হিসেবে বিপুল নামডাক হল পোড়াবাড়ির। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির টালমাটাল অবস্থা তখন। অবশেষে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল ইংরেজ শাসকদের হাত থেকে। কিন্তু কাঁটাতার পড়ল বাংলার বুকে। অতঃপর টাঙ্গাইলের অনেক ময়রাই চলে এলেন এপার বাংলায়। যেমন, দুই বন্ধু ধীরেন সরকার ও কালিদাস দত্ত। ময়মনসিংহ ছেড়ে জলপাইগুড়ির বেলাকোবা হল তাঁদের নতুন ঠিকানা। সঙ্গে আনলেন চমচমের ম্যাজিক!খানিক নিজস্ব ছোঁয়াও দিলেন তাতে।
শুধু ছানা-ময়দা-চিনি নয় বরং খোয়া ক্ষীর যুক্ত হল নতুন চমচমে। একটু বেশি পরিমাণেই। কিন্তু তাতে স্বাদের মাত্রা বেড়ে গেল ততোধিক। একদম শেষে,উপরে ক্ষীরের আস্তরণ। বাঙালির পাতে হাজির একদম নতুন বেলাকোবার চমচম। খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে সময় বেশি লাগেনি। ভারতের বাইরেও সে সমানভাবে দীপ্যমান। সেই প্রবাদপ্রতিম দুই বন্ধুর মিষ্টির দোকান এখনো আছে জলপাইগুড়ির বেলাকোবায়। বেলাকোবার রেললাইনের দুই পারে অবস্থান তাদের।
প্রসঙ্গত জী বাংলার দাদাগিরির একটি শোয়ে, সৌরভ গাঙ্গুলি একটি প্রশ্ন করেছেন
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে টাঙ্গাইলের নদীর ধারে পোড়াবাড়ির এই মিষ্টির জনপ্রিয়তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দেশভাগের সময় ধীরেন সরকার এবং কালিদাস দত্ত চলে আসে এ বাংলায়। পরবর্তী সময়ে, এই দুই বন্ধুর হাত ধরে জলপাইগুড়ির বেলাকোবা দারুন জনপ্রিয়তা লাভ করে এই মিষ্টি কোন মিষ্টি? উত্তরটি হবে: বেলাকোবার মিষ্টি, কিন্তু দুজন উত্তরটি ঠিক দিতে পারে নী। আর এই টিভি শোয়ের পরেই, সোসিয়াল মিডিয়ায় তুমুল ভাইরাল হয় এই বেলাকোবা চমচমের পোস্ট।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা, অপু গোস্বামী জানান। এর ইতিহাসটা ঠিক আমার জানা নেই কারণ এই বেলাকোবার চমচমের প্রভাব আমাদের জন্মের আগে থেকে। তবে আমার ৫৯ বছর পর্যন্ত আমি যা দেখে এসেছি। এখন দুধের ভেজালের কারণে একটু কোয়ালিটি টা কমেছে, তার মূল কারণটা দুধ। তবে এখনও যদি গ্রামে থেকে দেশি গরুর দুধ পাওয়া যায়, তাহলে ফের কোয়ালিটিটা ফিরে পাওয়া যাবে। কারিগরিরা এখনও ঠিক তেমনি ভাবেই চমচম বানাচ্ছে, যেভাবে তাদের বাবা দাদুরা শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। এখন বেলাকোবায় চমচম বলতে ২ টি দোকান, একটা দত্ত মিস্টান ভান্ডার যেটা সতীশ দত্তের বাবা, কালী দাস দত্তের তৈরি, এবং একটা সরকার সুইট, যেটা ধীরেন সরকারের তৈরি, উদয় সরকারের বাবা
এখনো সেই দুই চমচম খ্যাত পরিবারের লোকেরাই নিজেদের হাতেই তৈরি করছেন চমচম। এদিকে দাদাগিরিতে আমাদের বেলাকোবার নিয়ে চমচমের প্রশ্ন করাতে আমরা বেলাকোবা বাসি হয়ে গর্ববোধ করি। কারণ এখন বিশ্বজুড়ে মানুষ দেখলো। আগে দিল্লি বোম্বে থেকেও বেলাকোবার চমচম অর্ডার হতো, এখনও হয়। এখন দাদাগিরির জন্য আবার বেশি প্রচার হলো। বেলাকোবার চমচমের মূল যা বৈশিষ্ট তা হলো, সাধারণ চমচমে খেতে শুধুই মিষ্টি এবং চমচমের ভেতরেও বাইরের মতই স্বাদ। তবে বালাকোবা চমচমের বৈশিষ্ট্য একেবারেই আলাদা, এই চমচমের ভেতর মৌমাছির চাকের মত মধুর রসের মতই স্বাদ পাওয়া যায়।
এদিকে স্থানীয় এক চমচম ক্রেতা, অজিত কুমার সরকার জানায়, আগের দোকানটা ভেঙে যাওয়ার কারণে একটু অসুবিধে মধ্যে হলেও আমরা এখনো এখানে চমচম নিতে আসি। যেকোনো অনুষ্ঠানে হোক বা কোনো কার্যের ক্ষেত্রেই হোক আমরা এখান থেকেই চমচম নিয়ে যাই। তার কারণটা হয়তো সবাই জানে। তবে দুধের ভেজালের জন্য একটু গুণগতমান কমলেও তবেও আগের স্বাদ এখনও টিকে রেখেছেন কারিগররা।
দত্ত মিষ্টান ভান্ডারের ব্যবসায়ী কালিদাস দত্তের ছেলে সতীশ দত্ত জানিয়েছেন আমাদের বাবা যা শিখে গিয়েছেন। তার ঐতিহ্য আমরা ধরে আছি এবং ধরে রাখবো। তবে আগের দিনের থেকে এখন, পার্থক্য শুধু এটাই চমচম বানাতে মূল সঞ্জনা হিসেবে কাজে লাগে ছানা। আর সেই ছানা বানাতে গেলেই প্রয়োজন হয় আসল দুধ। এখন দুধেই যদি ভেজাল থাকে তাইলে আমাদের করণীয় কিছুই থাকে না। আমরা যথাযথ চেষ্টা করে থাকি সেই আগের দিনের স্বাদটা টিকে রাখার জন্য। এবং আগে আমরা চমচম বানাতাম জ্বালানির উনানে, এখন আর সেরকম জ্বালানি কাঠও পাওয়া যায় না। এখানেই কিছুটা হলেও পার্থক্য হয় কারণ জ্বালানি উনান এবং গ্যাসের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য দেখা যায় চমচমে।
সরকার মিস্টান ভান্ডারের ছেলে উদয় দে সরকার জানিয়েছেন, এর ইতিহাসটা শুরু হয় অনেক আগে, প্রথমে বাবা যখন বেলাকোবায় আসেন। তখন বাবা মাথায় করে চমচম বিক্রি করতেন, এই ভাবে চমচম বিক্রি করতে করতেই জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর। আমরা এই দোকানটি দিয়ে থাকি। তবে আগের মতো সেই দুধ আর পাওয়া না যাওয়াতে, একটু হলেও স্বাদ কমেছে। তবে আমরা চেস্টা করেই যাচ্ছি সেই আগের স্বাদ রাখার জন্য।
স্থানীয় বিধায়ক খগেশ্বর রায় জানান, বেলাকোবার চমচম সর্বত্র শিরোনামে এসেছে। জিআই স্বীকৃতির জন্য তিনি যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন জানাবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
রাজগঞ্জের বিডিও পঙ্কজ কোনার জানান, বেলাকোবার চমচম তাঁদের ব্লকে একটি গৌরবের বিষয়। চমচমের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে কোনও বেসরকারি উদ্যোগে বেলাকোবায় দুগ্ধ প্রকল্প করতে চাইলে সেক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা ছাড়া অন্যান্য প্রশাসনিক সহযোগিতা করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।